1. info@dainiknetrojolsahitthomagazine.com : দৈনিক নেত্রজল সাহিত্য ম্যাগাজিন : দৈনিক নেত্রজল সাহিত্য ম্যাগাজিন
  2. info@www.dainiknetrojolsahitthomagazine.com : দৈনিক নেত্রজল সাহিত্য ম্যাগাজিন :
বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:১৩ অপরাহ্ন

গল্প – অসমান। কবি: মহুয়া মিত্র। কলকাতা ভারত

  • প্রকাশিত: সোমবার, ১১ নভেম্বর, ২০২৪
  • ৯৪ বার পড়া হয়েছে

গল্প – অসমান
কলমে মহুয়া মিত্র
কলকাতা
ভারত

ক্যালেন্ডারের পাতায় যদিও মাঘ মাস কিন্তু প্রকৃতির দিকে তাকালে ঋতুচক্রের হিসাবে ভ্রম লাগে। গত এক সপ্তাহ ধরে টিভি বা সংবাদ পত্রে লাগাতার প্রচার চলছিল আজকের এই ঝড়ের তান্ডবের কথা। ঝড়ের হাত থেকে রক্ষা পেতে চারিদিকে চলছিল যুদ্ধকালীন তৎপরতা। কিন্তু গতকাল সকালেও যখন ঝলমলে রোদ উঠলো ঠিক তখনই সাধের বাগানে বড়ো শখ করে লাগানো পৌষ মেলা থেকে কেনা বেতের দোলনায় গরম ধোঁয়া ওঠা কফি নিয়ে আয়েশ করে বসল সাহানা। বড্ড গাছের সাধ ওর। গোটা শীতের ফুল উপচে পড়ছে বাগানে। তার জৌলুসে চোখে ধাঁধা লাগে। সেখানে বসে তারিয়ে তারিয়ে কফিতে চুমুক দিয়ে দীপঙ্করের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললো, — ” কত দিন হল কোথাও যাই নি! কাল পরশু তো শনি রবি, তোমার অফিস বুবুর স্কুল সব ছুটি। চলো না মাধবপুর থেকে ঘুরে আসি।”

মাধবপুর দীঘা সংলগ্ন একটি প্রত্যন্ত গ্ৰাম, দীপঙ্করের দেশের বাড়ি ওখানে। বেশ বড়সড় বাড়ি, ফাঁকাই পড়ে থাকে তবে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে কেয়ার টেকার রাখা হয়েছে বলে যত্নের অভাব নেই। কালেভদ্রে দীপঙ্কর একা বা সপরিবারে যায়। বেশ ভালোই লাগে। কিন্তু এই ঝড়ের পূর্বাভাসে ওখানে যাবার কথা শুনে আঁতকে উঠলো দীপঙ্কর, — ” তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল সাহানা? এত বড় একটা ঝড় আসছে আর তুমি যেচে ঐ সময়েই সমুদ্রের দিকে যেতে চাইছো? অসম্ভব।”

— ” আরে ঝড় তো হবে বাইরে আর আমরা থাকবো ঘরের ভেতর। তাছাড়া আমাদের শক্ত পোক্ত পাকা বাড়ি, ভয়ের কিছু নেই। আর গ্ৰামের লোকেরাও আছে, তারা তো আর ঘর বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছে না।” নাছোড়বান্দা সাহানা।

শেষ পর্যন্ত স্ত্রীর জেদের কাছে হার মেনে পরদিন ভোর ভোর নিজের গাড়ি নিয়ে দীপঙ্কর পরিবার সমেত রওনা হল। পথে কোনো সমস্য হল না, দিনটাও পরিষ্কার। দীপঙ্কর ভাবলো বিপদ বুঝি কেটে গেছে। রাস্তায় লোকজন, যানবাহন সবই ছিল যদিও সংখ্যায় কম।

দশটার দিকে দীপঙ্কর বাড়ি পৌঁছতে ওখানকার কেয়ার টেকার মধু ছুটে এলো, — ” দাদাবাবু আসার আর দিন পেলেন না, একেবারে দুর্যোগের দিনেই আসতে হলো? আর এসেই যখন গেছেন তখন থাকুন তবে আমি থাকবো না। দুপুর রাতের রান্না করে রেখেছি, কিছু বাজার মজুদ আছে, অসুবিধা হবে না। গ্ৰামে কেউ নেই, সব আশ্রয় কেন্দ্রে চলে গেছে এমনকি আমার পরিবার পর্যন্ত। আমি এবার যাবো, মাফ করবেন, থাকতে পারবো না। ভগবানের স্মরণ নিন যাতে কিছু না হয়। দু’হাত দূরে সমুদ্র, বড়ো ঝড় এলে কি হবে ভাবলেও ভয় হয়।” বলে মধু চলে গেল। বাইরে তখন খটখটে রোদ।

কিন্তু সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে পারল না। কোথা থেকে রাজ্যের কালো মেঘ এসে দখল করল আকাশটা। সাথে সমান তালে ঝোড়ো হাওয়া। বিকেলে এল মুষলধারে বৃষ্টি, সঙ্গে বীভৎস বজ্রপাত। চারিদিক থেকে ভেসে আসছে সব লন্ডভন্ড হবার আওয়াজ। কোথায় থেকে যেন একরাশ কালো নোংরা জল এসে দখল করেছে বাড়ির একতলাটা। আর দোতলায় এক কোণে অসহায় ভাবে বসে দীপঙ্কর। পাশে ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে ছোট্ট বুবু। আর খাটে শুয়ে অসহ্য বুকের যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে সাহানা। গোটা গ্ৰাম জনমানব শূন্য। কাছাকাছি হাসপাতাল বলতে দীঘা। কিন্তু অতটা যাবে কি করে? গাড়ি যে কোথায় ভেসে গেছে কে জানে! আর বাইরে তো তখন মৃত্যু দূতের আনন্দোৎসব।

সারা রাত তান্ডব চালিয়ে অবশেষে বিদায় নিল ঝঞ্ঝা। প্রথম সূর্যের আলো দেখে দু’একটা পাখি ডাকতে শুরু করে ছিল সবেমাত্র, চারপাশের ধ্বংস লীলা দেখে তারা চুপ করে গেছে। অদ্ভুত থমথমে পরিবেশ। মাধবপুর প্রায় নিশ্চিহ্ন। তবু মধু আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে নিজের বাড়িতে না গিয়ে সোজা চলে এলো দীপঙ্করের বাড়ি। বাড়ির হাল দেখে খুব কষ্ট হলো ওর। এত যত্নে থাকা বাড়ির একি দশা! অনেক ঝামেলা করে দোতলায় উঠে ভয়ে বুক কেঁপে উঠল মধুর। এত চুপচাপ, এত শান্ত কেন সব? দাদাবাবু, বৌদি নয় হল কিন্তু বুবু তো চুপ থাকার নয়, ওর দাপাদাপি তো চলতেই থাকে! তাহলে? কি সর্বনাশ হল? যার খেয়ে পরে বেঁচে আছে তাকে ঐ অত দুর্যোগে ছেড়ে যাওয়া উচিত হয়নি ওর, নিজেকে দুষলো মধু।

অনেক কষ্টে ঢোঁক গিলে গলা দিয়ে আওয়াজ বের করলো মধু, — ” দাদাবাবু?”

পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো দীপঙ্কর, কোলে ঘুমন্ত বুবু। দীপঙ্করের রাত জাগা চোখের তলায় গাঢ় কালি। এক রাতেই বুঝি মানুষটা বৃদ্ধ হয়ে গেছে। মধু কি করবে বুঝতে পারছে না। দীপঙ্কর ক্ষীণ স্বরে বলল, — ” কি ঝড় রে মধু, সব শেষ হয়ে গেল। কোন অজানা কারণে তোর বৌদির বুকে তীব্র ব্যথা উঠলো। সাথে যা টুকটাক ওষুধ ছিল তাতে কিছু হল না। যত ঝড় বাড়ে তত সাহানার ব্যথা বাড়ে। কি কষ্ট পেল মেয়েটা। তারপর ঝড়ও কমল, সাহানার ব্যথাও সারল। এখন বড়ো আরামে ঘুমিয়ে আছে ও, আর জাগবে না। আমার এত অর্থ, এত পরিচিতি, তা সত্ত্বেও আমি কিছুই করতে পারলাম না। সম্পূর্ণ বিনা চিকিৎসায় আমার চোখের সামনে ও মারা গেল রে মধু।” বলে কান্নায় আছড়ে পড়ল দীপঙ্কর।

আগে থেকে পূর্বাভাস ছিল বলে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ঠিক কিন্তু গোটা ঝড় কবলিত এলাকায় কেউ মারা যায় নি। আর ভাবতে পারছে না মধু। প্রকৃতি এত নিষ্ঠুর! তবে যে সবাই বলে প্রকৃতি মা? মা কি করে এমন করলো? ভেবে পায় না মধু।

কেটে গেছে অনেকগুলো বছর।
আজ আবার এক ভয়াবহ দিন। প্রকৃতির ভয়াল গ্ৰাসের কবলে প্রাণীজগত। মারাত্মক প্রলয় শুরু হয়েছে পৃথিবী জুড়ে। মধুদের পুরো গ্ৰাম এসে জুটেছে সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে। দুপুর ঘনাতে না ঘনাতেই রাত হয়ে গেছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঝড়ের গতিবেগ। এর সাথে শুরু হয়েছে মধুর পুত্রবধূর তীব্র প্রসব বেদনা। অসহায় মানুষগুলো শুধু বোবার মত তাকিয়ে আছে বাইরে, এছাড়া আর করবেই বা কি!

আচমকা দেবদূতের মত প্রবেশ করল ডাক্তারবাবু সঙ্গে দু’জন নার্স। কিছু ক্ষণ পর ঝড়ের আওয়াজ ছাপিয়ে এলো নবজাতকের কন্ঠস্বর। নার্স জানালো ছেলে হয়েছে, মা শিশু উভয়েই সুস্থ। মধু এসে ডাক্তারের হাত ধরে কেঁদে উঠলো। তরুণ ডাক্তার মধুকে জড়িয়ে বলল, — ” আমি যতক্ষণ পর্যন্ত আছি মধুকাকা, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো ঝড় জল তুফান তোমাদের ক্ষতি করতে পারবে না। এক ঝড় আমার মাকে আমার থেকে কেড়ে নিয়েছে। তাই তো শত প্রলোভন উপেক্ষা করে আমি এই গন্ডগ্ৰামে হাসপাতাল তৈরি করে আছি যাতে তোমরা ভালো থাকো। এখন যাও, নাতির মুখ দেখো।”

চোখ মুছে মধু তাকালো ডাক্তারের দিকে। ভাবলো ভাগ্যিস আজ বুবু ছিল, না হলে কি হতো ভেবেই গা শিউরে উঠলো মধুর। ঈশ্বরের চরণে বুবুর জন্য আশীর্বাদ প্রার্থনা করে মধু গেল নাতির কাছে। বুবুর মুখে তখন যুদ্ধ জয়ের হাসি।

শেয়ার করুন

আরো পড়ুন
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট