গল্প – পালা বদলের কাহিনী
কলমে — মহুয়া মিত্র
সবে চৈত্র গেল আর বৈশাখ এলো, অথচ এর মধ্যেই চরচন্দনপুর একেবারে ফুটিফাটা। পাশেই বয়ে চলেছে শীর্ণকায়া মহানন্দা কিন্তু তার সে যোগ্যতা কই যে প্রকৃতির রোষ থেকে এই ছোট্ট গ্ৰামকে রক্ষা করে! জল কষ্ট, অন্নাভাব তো আছেই, সেই সঙ্গে চাষের জমিও জ্বলছে। সারা গ্ৰাম জুড়ে ত্রাহি ত্রাহি রব। তবু তার মধ্যে গোস্বামী পাড়া যেন মরুভূমির বুকে এক টুকরো মরূদ্যান আর বিশ্বম্ভর গোস্বামীর মাটির ঝকঝকে তকতকে দোতলা বাড়ি যেন ছবির বই থেকে উঠে আসা এক কোলাজ। পুকুরে স্নান সেরে গনগনে রোদে তেতেপুড়ে বাড়ি আসতেই বিশ্বম্ভর গিন্নি এক গ্লাস বেলপানা স্বামীর হাতে ধরিয়ে আদুরে গলায় বলল, –” শুনলাম বোশেখ শেষ হবার আগেই না কি যদুগোপালবাবুর ছেলের বিয়ে। তা আপনাকেও তো ডেকেছে বলে কানে এলো।”
–” কি যে বলো গিন্নি। যদুগোপালবাবু হলেন এই তল্লাটের মাথা। তার ছেলের বিয়ে মানে বিরাট ধুম। সেখানে আমার ডাক পড়বে না তাই হয়?” বলে এক নিঃশ্বাসে সবটুকু খেয়ে গ্লাসটা ফেরত দিলে বিশ্বম্ভর।
–” শুনলাম মেয়ে কলকাতার। লেখাপড়াও জানে। তা তার বাড়ির লোকজনও তেমন বুঝদার হবে বৈকি। আহা, তাদের মধ্যে আপনি থাকবেন এ ভেবেও শান্তি।”
–” না, গিন্নি না। মুখে বলছো বটে কিন্তু গলায় তোমার অন্য সুর। বলো দেখি মতলবখানা।”
মাথার আঁচলটা মুখে টেনে এক গাল হেসে বিশ্বম্ভর গিন্নি বললে, –” আপনার কাছে কিছু লুকানোর সাধ্যি কই? বলছি যে এত বড় একটা কান্ড যখন, তখন সিধেটাও ভালো আসবে। আপনি যদি একটু বলতেন তাহলে আমার একখান গরদ আর দুই বৌমার জন্য ঢাকাই শাড়ি, এই আর কি।”
বিশ্বম্ভর কিছু বলার আগেই বাইরে থেকে ডাক এলো, –” বিশ্বম্ভর,বলি আছো ?”
–” ও গিন্নি, তোমার মনোবাসনা পূর্ণ হলো বলে। ঐ যদুগোপালবাবু এসেছেন। যাও, তাড়াতাড়ি সরবত-মিষ্টির বন্দোবস্ত করো। আজ্ঞে আসছি কর্তা।” বলে ধরমর করে বেরিয়ে এলো বিশ্বম্ভর।
জনা তিনেক ডান হাত – বাম হাত, একজন ছাতাধারী ও গোটা দুই ঝাঁকাধারী সহ তপ্ত উঠোনে যদুগোপালবাবুকে দেখে হে হে করে উঠলো বিশ্বম্ভর, –” এই গরমে বাইরে কেন কর্তা? ভেতরে এসে বসুন আপনারা, কৃতার্থ হই।”
–” বসছি হে বসছি। তার আগে তুমি ঐ ঝাঁকা দুটো খালি করার ব্যবস্থা করো। এই রোদ গরমে ও বেচারারা এত দূর হেঁটে এলো।” বলে যদুগোপালবাবু ঘরে ঢুকে বসলেন।
বিশ্বম্ভর বলে উঠলো, –” সে আর বলতে। ওহে তোমরা বাড়ির পিছনে যাও, ওখানে গিন্নি মা আছে। খানিক জিরোও, জলটল খাও। তা কর্তা, এত কিছুর কি দরকার ছিল!”
ফল-মিষ্টি-দুধ-মাছ-সবজি ভর্তি ঝাঁকা দুটো ভেতরে চলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে যদুগোপালবাবু বললেন, –” এ কিছুই না বিশ্বম্ভর। আমার ছেলের বৌভাতে সব কলকাতা থেকে বড়ো মানুষেরা আসবে। সেদিন সারা রাত তোমাদের পালা জমাতে হবে। সেখান থেকে বখশিস তো পাবেই আর তারপর তো আমি আছিই। বলি তোমার এবং তোমার দলের সকলের সপরিবারে সেদিন আমার ওখানে সারা দিন নিমন্ত্রণ। ওবেলা বাড়ির ঝি আসবে কিছু চালের সিধে নিয়ে। তা তোমার অন্দরের কোনো রকম আবদার থাকলে যেন তাকে বলে দেয়। তা বিশ্বম্ভর, তোমার খিড়কি পুকুরে জলের কি অবস্থা?”
–” ভালো অবস্থা কর্তা। ঐ পুকুর তো শুধু আমার বাড়ির লোক ব্যবহার করে। তাই এই গরমেও জলে ভরপুর। তাছাড়া কর্তা, গোস্বামী পাড়ার জন্যেও যে পুকুর কাটিয়ে দিলেন তাতেও জল আছে। গোটা চরচন্দনপুর খরায় গেলেও আপনার দয়ায় আমরা সুখেই আছি। ”
–” কি যে বলো বিশ্বম্ভর! আমার দয়া না হে। সবই ভোলা মহেশ্বরের দয়া। তিনি দিচ্ছেন তাই আমি দিচ্ছি। তাছাড়া তোমরা হলে ওনার পূজারী, তোমাদের দেওয়াও যা ওনাকে দেওয়াও তাই। আচ্ছা, এবার উঠি। অনেক দূরে যেতে হবে। তাহলে যা যা কথা হলো মনে রেখো। আর তোমার সাগরেদদের বলবে তাদের সিধেও যথা সময়ে পৌঁছে যাবে। তোমরা শুধু কুটুম বাড়ির সামনে আমার মাথা হেঁট হয়ে যেতে দিও না। চলি হে।”
সেদিন বিকেলে বিশ্বম্ভরের বাড়ির উঠানে সকলে জমায়েত হয়েছে। চিন্তিত মুখে রামলোচন বললে, –” সবই তো বুঝলাম বিশু খুড়ো, কিন্তু চার দিনের পালা আমরা এক রাতে নামাবো কিভাবে?”
পাশ থেকে খেঁচিয়ে উঠলো নগেন গোস্বামী, –” থাম দিনি রামলোচনা। দু’দিন হলো গম্ভীরা করতে এসে চিন্তায় ভরপুর। এই আমরা গম্ভীরা গাইতে গাইতে মাথার চুল পাকিয়ে ফেললাম, পালা যখন হবে বলেছি তখন হবে। তাছাড়া আমাদের বিশ্বম্ভর পাকা মাথার লোক। ও ঠিক একটা উপায় বের করবেই।”
হুঁকাগাছাটি পাশে রেখে মাধব বুড়ো বলল, –” বিশ্বম্ভর আমাদের গম্ভীরা দলের প্রধান হলেও বয়সে প্রবীণ হবার সুবাদে একটা কথা বলি। চারদিনের পালা একথা ঠিক কিন্তু সে তো বছরে ঐ একবার গাজনের সময়। অন্য সময় পূজো পার্বণে আমরা যেটা করি সেগুলো হয় দ্বিতীয় দিনের ছোট তামাশা অর্থাৎ ঢাক ঢোল পিটিয়ে শিব বন্দনা বা শেষ দিনের সং সেজে গান। কিন্তু এবার ব্যাপার আলাদা। তাই বলছি এই দুটোই থাক। প্রথম দিনের ঘট ভরা বা শিব পূজো অথবা নীল পূজো, তৃতীয় দিনের বড়ো তামাশা বা গাজন, চড়ক এসব তো সম্ভব নয়। তবে হ্যাঁ, জমিয়ে করতে হবে। ”
–” ঠিক বলেছেন কাকা। তবে তাই হোক। এখানে মানুষ আসবে ফুর্তি করতে। তাদের আনন্দ দান মুখ্য উদ্দেশ্য হবে। তবে আমরা তো শিব বন্দনা করি এই পালার মধ্যে দিয়ে। তাই শিব বা গম্ভীর বন্দনাও হবে ছোট করে। যাও যাও সব, কাজে লেগে পড়ো, মহড়া শুরু করো। আমাদের মুখোশ, বাজনা সব ঠিক করো। আশেপাশে আরো গম্ভীরা দল আছে কিন্তু যদুগোপালবাবু আমাদের ডেকেছেন। মালদহের গম্ভীরা দলের মধ্যে আমরাই সেরা এটা কলকাতার মানুষের কাছে প্রমাণ করে দেব। জয় ভোলা নাথের জয়।” বিশ্বম্ভর গোস্বামীর চোখে খুশির ঝিলিক খেলে যায়।
ক’দিন বিশাল হৈ হুল্লোর শেষে আজ সেই রাত যখন যদুগোপালবাবুর বাড়ির ছাদে অনুষ্ঠিত হবে বিশ্বম্ভর গোস্বামীর দলের গম্ভীরা পালা। ঝলমলে চাঁদোয়ার চারপাশে পর্যাপ্ত আলো রাখা হয়েছে। বিশেষ অতিথিদের জন্য আরামদায়ক চেয়ার এবং একপাশ ঘিরে মেয়েদের বসার ব্যবস্থা। অবশ্য নতুন বর কনেও থাকবে যাদের জন্য পৃথক আরাম কেদারা। যাইহোক, ভোজন পর্ব শেষ হতে বেশ রাত হলো। এরপর সকলে আসন গ্রহণ করতে আগে থেকেই চাঁদোয়ার মাঝখানে রাখা একটা শিবলিঙ্গে আকন্দর মালা পরিয়ে মূল অনুষ্ঠান শুরু করল স্বয়ং বিশ্বম্ভর, পরনে সাদা ফতুয়া ও সাদা ধুতি। নেপথ্যে বেজে উঠলো ঢাক-ঢোল-কাঁসি। ঘুরে ঘুরে গান ধরল সে, “শোনো শোনো সুধীজন, শোনো দিয়া মন/অপূর্ব গম্ভীরা কথা করিব বর্ণন/আদ্যের গম্ভীরা নয়, হবে পালা গম্ভীরা/ শিবের মাহাত্ম্য কথা মুখে মুখে রচিয়া/শিব আছে আর আছে মাতা পার্বতী/নন্দী ভৃঙ্গী তারই মাঝে আসিয়াছে জুটি/শিবের মাহাত্ম্য বলি গম্ভীর সে বচন/ কর জোরে স্মিত করো তোমার ও বদন”। এমন সময় চার পাঁচ জনের একটি দল যারা শিবের অনুচর বেশধারী, প্রবেশ করল হৈহৈ রবে। বাদ্য সহযোগে তারা বোল তুলল শিবস্তুতির, “বলো শিব হে, শিব হে, শিব হে/বলো নানা হে, নানা হে, নানা হে “, ওদিকে ততক্ষণে বিশ্বম্ভর শিবলিঙ্গ ঘিরে দুই হাত তুলে ঘুরে ঘুরে নাচছে, “শিব হেএএএ, নানা হেএএএ, জয় গম্ভীরের জয়”।
পরবর্তী সময় ধরে পুরুষ অভিনেতারাই পার্বতী, মেনকা,জয়া-বিজয়া সেজে দাপিয়ে অভিনয় করল শিব পার্বতীর বিয়ের বিভিন্ন অংশ। অবশেষে এলো শেষ অধ্যায়। বিশ্বম্ভর একা আরম্ভ করলো, “সুফি মাস্টারকে স্মরণ করে এবার শেষ করার অনুমতি দেন। এই খরা যেন বেশি দিন না থাকে সেটা দেখো নানা। হেই চলো ,ধরো গান, নানা হে,নানা হে,নানা হে, শিব লীলাখেলা করো অবসান/বুঝি বাঁচে না আর আমাদের জানা/অনাবৃষ্টি করলে কেন গো সৃষ্টি/মাটি করলা নষ্ট কেন হে/ হে, নানা হে, নানা হে, নানা হে “। সকলে প্রণামের ভঙ্গিতে দাঁড়ালে দর্শকাসন হাততালিতে ফেটে পড়ল। ভোরের প্রথম পাখিও ডেকে উঠলো কাছে কোথাও।
যদুগোপালবাবুর বেয়াই মশাই এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন বিশ্বম্ভরকে, –” ওহে বিশ্বম্ভর, এ কি শোনালে হে! আহা,মন প্রাণ জুড়িয়ে গেল। এ জিনিস কলকাতায় অমিল।”
–” তাহলে বেয়াই মশাই, বুঝলেন তো কেন বলেছিলাম এমন জিনিসের স্বাদ দেব যা কলকাতা কেন, এই মালদাতেও অমিল।” বলতে বলতে এগিয়ে এলো যদুগোপালবাবু, –” আশেপাশে আরো গম্ভীরা দল রয়েছে। কিন্তু সবার সেরা এই বিশ্বম্ভর গোস্বামীর দল। ওর পালায় যেন স্বয়ং ভোলা মহেশ্বর ভর করে।”
বেয়াই মশাই বললেন, –” তা এখানেই সারা বছর পড়ে থাকা হয় না কি? কলকাতা যাও দল নিয়ে? বায়না দিয়ে গেলাম আসছে রথযাত্রায় আমার বাড়িতে পালা করবে। বেশ জমিয়ে করতে হবে বলে দিলাম। ইংরেজ সরকারের লোকও অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। চাইলে সরকার বাহাদুরের নজরেও পড়তে পারো। তাহলে আর তোমাকে পায় কে! বেয়াই মশাই, সঠিক সময়ে এদের কলকাতায় পাঠিয়ে দেবেন।” বলে উনি থামলেন। এমন সময় একজন কর্মচারী গোছের এগিয়ে এসে হাতে ধরা পুঁটলিটা দেখিয়ে বলল, –” আজ্ঞে কর্তা, এটা মা জননীদের দিক থেকে এসেছে। ওনারা এত সুন্দর আসর আগে দেখেন নি। তাই খুশি হয়ে সিধে পাঠিয়েছেন।”
বেয়াই মশাই বললেন, –” সত্যি বিশ্বম্ভর! কি অপূর্ব তোমার কন্ঠ, কি সুন্দর তোমাদের নৃত্য শৈলী। মুখোশ ও বাদ্যযন্ত্রও যথাযথ। তোমরা সেরা হবার উপযুক্ত। ওরে কে কোথায় আছিস? যা, সরকারবাবুকে বলে ওদের যথোপযুক্ত বকশিসের ব্যবস্থা কর।”
বিশ্বম্ভরেরাও মহা খুশি। এত বছরের গম্ভীরা আজ সার্থক। এত আনন্দ,এত খুশি আগে কখনো হয় নি। নাহ, কলকাতার আমন্ত্রণ বলে কথা। কাল থেকেই মহড়া শুরু। সকলের মনে গম্ভীরা পালাকে গেঁথে দেওয়াই এখন মূল লক্ষ্য।
আহ্নিক গতি বার্ষিক গতির নিরিখে দিন বদলের সাথে সাথে পাল্টায় যুগ। শীর্ণকায়া মহানন্দা কখনো ধুঁকতে থাকে আবার কখনো ফুলে ফেঁপে ওঠে। তার চরে পলিমাটির স্তরে স্তরে লালিত হয় আগমণীর স্বপ্ন। ফুটে থাকে কাশফুল। কালের নিয়মে প্রায় শহরে পরিণত হওয়া চরচন্দনপুর সেজে নেয় পূজার সাজে। পুজো আসছে যে! সকালের বাসে মালদা টাউন থেকে গ্ৰামে আসে নয়ন। চরচন্দনপুর নেমে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে, –” ধুর! না আছে একটা টোটো, না আছে কোন ভ্যান। নাও এবার হাঁটো এতখানি পথ। বাবাকেও বলে পারি না! কি দরকার পূর্ব পুরুষের ভিটে আগলে পড়ে থাকার? মালদা চলে গেলেই তো হয়। যত জ্বালা আমার!” বলে মুখ কুঁচকে গ্ৰামের পথে পা বাড়ায় নয়ন।
গ্ৰামের একদম শেষ প্রান্তে গোস্বামী পাড়া। নয়ন এসে একটা শ্রীহীন মাটির দোতলা বাড়ির সামনে দাঁড়ায়। চারিদিকে ঝোপ ঝাড়, আগাছা জঙ্গল। ভীষণ চুপচাপ পাড়া এটা। অবশ্য হবেই বা না কেন! বেশিরভাগ নব প্রজন্ম এই চরচন্দনপুর ছেড়ে বিভিন্ন শহরে থিতু হয়েছে। থাকার মধ্যে ওর বাবার মত কিছু একঘেঁয়ে বৃদ্ধ বৃদ্ধার বাস এদিকে। দরজাটা খোলাই ছিল। নয়ন উঠোনে পা দিতেই ভেতর থেকে ছুটে এলো একটা বাচ্চা মেয়ে, উষ্ক খুষ্ক লাল চুলে ছেঁড়া ফাটা জামা, –” মা, ও মা, শিগগির বেড়িয়ে এসো, কাকা এসে গেছে।”
ঢুকতে ঢুকতে পকেট থেকে একটা চকলেট বের করে মেয়েটির হাতে দিয়ে বলল, –” আজ তোর স্কুল নেই চাঁপা? না কি এরই মধ্যে পুজোর ছুটি পড়ে গেল?”
–” তুই যা চাঁপা।” বলে ভেতর থেকে এক বিধবা তরুণী বেরিয়ে এসে নয়নের হাতে জলের গ্লাস দিয়ে বলল, –” চাঁপা আর স্কুলে যায় না ঠাকুরপো। গত চার মাস বারবার বলা সত্ত্বেও ওর স্কুলের মাইনে দিতে পারি নি ভাই। তাই স্কুল থেকে ওকে ছাড়িয়ে এনেছি।”
–” আমাকে একবার বলার প্রয়োজন মনে করলে না বৌদি? মানছি এর মধ্যে বাড়ি আসতে পারি নি, কিন্তু ফোন তো ছিল।” হতাশ গলায় বলল নয়ন।
–” কোন মুখে বলি ঠাকুরপো? তুমি নিজেই টিউশন করে তোমার কলেজের পড়াশোনা চালাও। তারপর যা থাকে সবটাই এখানে পাঠাও। ঐ দিয়ে কোনো মতে খাওয়া খরচটুকু হয়। আমি কত বলি বাবাকে, ক’টা বাড়ি রান্নার কাজ করবো। কিছুতেই রাজি হন না। খালি বলেন এটা শিল্পীর বাড়ি, ওসব করলে এই বাড়ির মান সম্মান নষ্ট হবে।”
–” কি আমার মান সম্মান আছে ! তা বাবা কোথায় এখন?”
–” ওপরের ঘরে।”
ওপরে এসে নয়ন দেখল ভাঙা তক্তোপোষে বসে চোখ বুজে কি বিড়বিড় করছে নিত্যপদ গোস্বামী, সামনে একটা বিবর্ণ খোলা খাতা। বাড়িটার মতই বাড়ির বর্তমান মালিক, অস্থি চর্মসার। ঘরের প্রতিটি কোণায় নির্লজ্জের মত উঁকি দিচ্ছে অভাব আর অভাব। নয়ন কাছে এসে ডাকল, –” বাবা।”
চোখ মেলল নিত্যপদ, –” তুই কখন এলি? আয়, বোস। দেখ কাল রাতে আবর্জনা থেকে কি খুঁজে পেয়েছি।” বলে খুব সাবধানে খাতাটা তুলে ধরল, –” আমার আদিপুরুষ, আমার প্রপিতামহ ঈশ্বর বিশ্বম্ভর গোস্বামীর গম্ভীরা গানের খাতা। কি অপূর্ব সব সৃষ্টি।” পরম যত্নে খাতাটা মাথায় ঠেকালো নিত্যপদ।
–” বাবা, তুমি জানো চাঁপা আর স্কুলে যায় না? বৌদির শাড়িতে কতগুলো ছেঁড়া সেই হিসেব আছে? তুমি কতদিন ঠিক করে খাও না বলো? অসুখ হলে ডাক্তার দেখানোর ক্ষমতা আছে আমাদের? বাড়িটা কবে ভেঙে পড়বে সেই আশায় দিন গুনছো? ভুলে যেও না মা আর দাদা পুরো বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। তারপরও কেন তুমি এত উদাসীন বাবা? আচ্ছা বলো তো, বৌদির কি একটা ভালো শাড়ি পরার অধিকার নেই? চাঁপা কেন স্কুল যাবে না? কতবার বলেছি মালদা চলো। দোকানে খাতা লেখার কাজ আমি দেখে রেখেছি তোমার জন্য। বৌদির জন্যেও মহিলা স্ব-সহায়ক দলের কাজ আছে। কিন্তু তুমি কিছুই শুনছো না। এভাবে ক’দিন বাবা? যেটুকু সহায় সম্বল ছিল সব বিক্রি করে দিয়ে গানের জন্য ছুটেছো।গম্ভীরা এখন আর পেটের ভাত জোগাতে পারে না। কেউ এখন ও গান শোনে না।বাস্তবটা বোঝো। সরকারি অনুদান বা অনুষ্ঠান যোগাড় তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া এই গ্ৰামে তুমি ছাড়া আর কোন শিল্পী নেই। অবুঝ হোয়ো না, শহরে চলো। কাজ করে পেটের ভাত জোগাতে হবে। ” বলে কান্নায় ভেঙে পড়ল নয়ন। নিত্যপদর চোখ তখন শরতের আকাশ দেখছে। ছেলের কথা কানে গেল না কি কে জানে!
পুজো উপলক্ষ্যে দারুণ সেজে উঠেছে শপিং মলটা। ভিড়ে ভিড়াক্কার। কত অফার, কত ডিসকাউন্ট! নতুন জামা কিনে পুজোর সাজ সাজতে সবাই ব্যস্ত। মলে ঢোকার ঠিক আগে, গেটের পাশে একটা বুড়ো বসে কি সব বিড়বিড় করছে। পেটে ভীষণ খিদে। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না ঠিক করে। খুব মন দিয়ে শুনলে বোঝা যাবে বুড়ো গান করছে, ওর পূর্ব পুরুষের গান, –” শিব হে, শিব হে, শিব হে, নানা হে, নানা হে, নানা হে।” এক আধটা খুচরো জমা হচ্ছে ঠিকই তবে যেমন শুনেছিল কলকাতার আকাশে বাতাসে টাকা ওড়ে, এখানে গুণীর কদর হয়, তেমন হচ্ছে কোথায়! সেই জন্যই ভোররাতে ট্রেন ধরে চরচন্দনপুর থেকে কলকাতা এসেছে নিত্যপদ। কাউকে কিছু বলে নি। পয়সা যদি রোজগার করতে হয় তো একমাত্র পালা গেয়ে। বিশ্বম্ভর গোস্বামীর বংশধর কখনোই অন্য কাজ করবে না। পারিবারিক ঐতিহ্য বলে কথা!
বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে অবশেষে এখানে বসেছে তাও অনেক সময়। সারা দিন খাওয়া হয় নি। যেটুকু পয়সা আছে তা দিয়ে খেয়ে নিলে বাড়ি নিয়ে যাবে কি? না, সহ্য করতে হবে। বংশের নাম রাখা কি অতই সহজ!
হঠাৎ কানে এলো পাশে দাঁড়িয়ে দুই যুবক বলাবলি করছে, –” এতটা রাস্তা বাসে আসতে আসতে সিনেমাটা দেখছিলাম। ওহ, কি থ্রিল। কিন্তু নেট শেষ। ফোনে তিনশ টাকার নেট ভরে নি, বাকিটা যেতে যেতে দেখব।”
এরা সিনেমা দেখতে তিনশ টাকা খরচ করে! চোখ কপালে নিত্যপদর। তাহলে কি এদের গান শোনালে বেশি রোজগার হবে? যতটা সম্ভব গলা তুলে গান ধরে নিত্যপদ। যুবকটি বলে ওঠে, –” ওরে বাবা, এই বুড়ো আবার এ কি গান ধরল! শিব হে, নানা হে। কোথা থেকে যে আসে এরা! যত্তসব। চল এখান থেকে।”
আরেকজন একটা দশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিল, –” ওপাশে একটা মন্দির আছে। রোজ দুপুরে ওখানে ভিখিরিদের জন্য খাবার দেয়। তুমি বরং ওখানে যাও।” বলে ওরা চলে গেল।
গভীর রাত। অনেকক্ষণ আগেই ট্রেন থেকে নেমেছে নিত্যপদ। কিন্তু বাড়ির পথ ধরে নি। পকেটে নিদেন শ’খানেক টাকাও নেই। কোন মুখে যাবে সেখানে? আর গিয়ে বলবেই বা কি? যে গম্ভীরা পালার জন্য তার এত অহংকার, সেই গম্ভীরা সে বেচতে গেছিল? চোখের সামনে এক এক করে ভেসে উঠছে প্রিয়জনদের মুখ। অভাগী পুত্রবধূ, নিষ্পাপ ফুটফুটে নাতনি আর সংসারের জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়া ছোট ছেলে যাদের ভালো রাখতে গিয়ে আজ সে শিল্পী নয়, ভিখিরির দলে পড়ে গেছে! কত গর্ব ছিল পরিবারের শিল্পী সত্ত্বা নিয়ে। কিন্তু আজ সব গেল। এতদিন সম্মান না পেলেও পুজো পার্বণে খুব সামান্য গান করেও তৃপ্তিটুকু অন্ততঃ পেয়েছিল। তবে আজ সবটাই শেষ। পারলে না বংশের নাম বজায় রাখতে। ছিঃ নিত্যপদ, ছিঃ। এই তুমি বিখ্যাত গম্ভীরা গাইয়ে বিশ্বম্ভর গোস্বামীর বংশধর! ধিক্ তোমারে!
সামনে স্রোতস্বিনী মহানন্দা। বর্ষার পর কানায় কানায় পূর্ণ। রেল ব্রিজ থেকে নদী অনেক নিচে। চারিদিকে কেউ নেই। এই তো সময় বংশের লজ্জা মোছার। চোখ বুজল নিত্যপদ। মনে মনে আউড়ালো, –” হে পূর্ব পুরুষগণ, ক্ষমা করুন আমায়। আপনাদের ঐতিহ্য আমি ধরে রাখতে পারলাম না। এখন এই নদীর জলেই হোক আমার শেষ প্রায়শ্চিত্ত। ভোলা মহেশ্বরের কোলেই বিলীন হয়ে যাবে তার এই গোস্বামী পরিবারের শেষ গম্ভীরা গায়ক।”
দূর থেকে একটা ট্রেন আসছে ঝড়ের বেগে। আমূল কেঁপে উঠলো নিত্যপদ। কেউ সাক্ষী থাকল না এক শিল্পীর আত্ম সমর্পনের। এক সময় প্রবল বেগে ঐ জায়গা অতিক্রম করল ট্রেনটি। পুনরায় সব নিঝুম, কেউ কোথাও নেই। শুধু একটা রাত পাখি চক্রাকারে অন্ধকার আকাশে ঘুরতে ঘুরতে কর্কশ শব্দে ডেকে উঠলো। অনেকটা নিচে কালো মহানন্দা অদৃশ্য প্রায়।